*শুরু জগদ্ধাত্রী পুজো, জেনে নিন এই পুজোর ইতিহাস, মাহাত্ম্য আর পুজোর তিথি*
দুর্গা পুজোর মতো সব রীতি আচার মেনে দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা করা হয়। এই দেবীর চার হাত, তিনি সিংহের উপর আসীন। আর সিংহের নীচে থাকে একটি হস্তি মুণ্ড। মূলত কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরে মহা ধূমধামের সঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজো পালন হয়।
সারা বাংলায় জগদ্ধাত্রী পূজার একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। দুর্গাপূজার ঠিক এক মাস পর জগদ্ধাত্রী পূজা উদযাপিত হয়। কলকাতা ও আশেপাশের শহরগুলো থেকে মানুষ এই পূজায় যোগ দিতে ভিড় জমায়। মূর্তি এবং বিলাসবহুল প্যান্ডেল এই কয়েক দিনে এই শহরকে একটি নতুন চেহারা দেয়। কার্তিক মাসে পালিত এই পূজায় দেবী জগদ্ধাত্রী চার হাতে বিভিন্ন অস্ত্র বহন করেন। সিংহের পিঠে চড়ে দেবীর মূর্তিগুলো জায়গায় জায়গায় প্যান্ডেল শোভা পায়।
দুর্গাপূজার (Durga Puja) মতই দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা করা হয়। যা মা দুর্গার এক রূপ। এই উৎসবটিও দুর্গাপূজার মতো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষে পড়ে। প্রধানত এই পূজা গোষ্টাষ্টমীতে পালিত হয়। চারদিন ধরে চলে মায়ের পূজা। এই পূজা সপ্তমী থেকে অষ্টমী পর্যন্ত চলে। মা জগদ্ধাত্রীর উজ্জ্বল রূপের পূজা করা হয়।
কথিত আছে, রামকৃষ্ণ মিশনে (Ramkrishna Mission) এই উৎসবের সূচনা করেছিলেন রামকৃষ্ণদেবের স্ত্রী ম সারদা দেবী। এর পরই, এই উত্সবটি বিশ্বের প্রতিটি কোণে উপস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনে পালিত হয়েছিল। এই উত্সবটি মা দুর্গার পুনর্জন্ম হিসাবে উদযাপন করা হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে দেবী মন্দের বিনাশ করতে এবং তার ভক্তদের সুখ ও শান্তি দিতে পৃথিবীতে এসেছিলেন।
মা দুর্গার পূজার মতোই এই পূজা করা হয়।
এতে বিশেষ করে মানুষ তার ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রণ করার জ্ঞান লাভ করে।
অহংকার বিনাশই এই উৎসবের উদ্দেশ্য।
এই উৎসবে জগদ্ধাত্রী দেবীর একটি বড় মূর্তি প্যান্ডেলে স্থাপন করা হয়।
প্রতিমাটি একটি সুন্দর লাল শাড়ি, বিভিন্ন ধরনের গহনা পরিহিত হয়।
দেবীর মূর্তিও ফুলের মালা দিয়ে সজ্জিত।
দেবী জগদ্ধাত্রী এবং দেবী দুর্গার রূপ হুবহু একই।
নবরাত্রির মতোই আয়োজন করা হয় পুজোর।
জগদ্ধাত্রী পুজো ২০২৩ কবে?
হুগলির চন্দননগরে চার দিন ধরে ঠিক দুর্গা পুজোর মতোই হয় জগদ্ধাত্রী পুজো। তবে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে একদিনে নবমী তিথিতেই জগদ্ধাত্রী পুজো হয়ে থাকে। জেনে নেওয়া যাক এই বছর কবে থেকে শুরু হচ্ছে জগদ্ধাত্রী পুজো।
১৯ নভেম্বর ২০২৩ জগদ্ধাত্রী পুজোর সপ্তমী
২০ নভেম্বর ২০২৩ জগদ্ধাত্রী পুজোর অষ্টমী
২১ নভেম্বর ২০২৩ জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমী।
২২ নভেম্বর ২০২৩ জগদ্ধাত্রী পুজোর দশমীতে হবে দেবীর বিসর্জন।
তবে মূল পুজো রীতি অনুযায়ী কৃষ্ণনগর – সহ অনেক জায়গাতেই কেবল নবমীতেই পুজো হয়। ২১ নভেম্বর পুজোর শুভ সময় শুরু হবে ভোর ৩টে ১১টা মিনিট থেকে আর নবমী তিথির অবসান হবে ২২ নভেম্বর সকাল ৯টা ০৩ মিনিটে।
কে দেবী জগদ্ধাত্রী?
কী ভাবে দেবী জগদ্ধাত্রীর (Maa Jagadhatri) সৃষ্টি হল, সেই সম্পর্কে পুরাণের একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। মহিষাসুর (Mahisasur) বধের পর দেবতারা অত্যধিক উল্লসিত ও গর্বিত হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা ভাবতে শুরু করেন, যেহেতু দেবী দুর্গা (Maa Durga) তাঁদের সম্মিলিত রূপের প্রকাশ, তাই মহিষাসুর বধের কৃতিত্ব আসলে তাঁদেরই। কেবলমাত্র ব্রহ্মার বরের সম্মান রাখতে একটি নারীদেহের প্রয়োজন ছিল। দেবতাদের দর্প চূর্ণ করার জন্য দেবীর এই রূপের সৃষ্টি হয়। জগদ্ধাত্রী (Jagadhatri Puja 2023) হলেন সেই দেবী, যিনি এই জগত্কে ধারণ করে রেখেছেন। দেবতাদের অহংকার চূর্ণ করতে ও তাঁদের শক্তি পরীক্ষা করতে তাঁদের দিকে একটি তৃণখণ্ড ছুঁড়ে দেন দেবী। কিন্তু ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু বা বরুণ দেব— কেউই সেই তৃণকে আটকাতে পারেননি। অগ্নিদেব সেই তৃণকে দগ্ধ করতে পারেন না, বায়ুদেব সেই তৃণকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। বরুণ দেব বৃষ্টি নামিয়ে তৃণখণ্ডকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেন না। তখন তাঁদের সামনে আবির্ভূতা হন স্বয়ং জগদ্ধাত্রী। এক সামান্য তৃণখণ্ডকে যে দেবতারা সরাতে পারেন না, তাঁরা মহিষাসুরকে কী ভাবে বধ করবেন, তা জানতে চান তিনি। এই ভাবে তিনি বুঝিয়ে দেন যে তিনিই এই সমগ্র জগতের ধারিণী শক্তি।
কিংবদন্তি অনুসারে, মহিষাসুর বধের পর দেবতাদের মধ্যে অহংকার আসে। তারা মনে করেছিল যে দেবী দুর্গা অসুরদের বধের জন্য তাদের যন্ত্র হয়ে উঠেছেন। তখনই দেবী স্বয়ং শক্তির প্রতীক হয়ে দেবতাদের উপলব্ধি করাতে আসেন যে তাদের প্রতিটি কর্মের মধ্যেই তার শক্তি লুকিয়ে আছে। তাই উপলব্ধি করাতে যক্ষ বায়ুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি তার জন্য কি করতে পারেন। তখন বায়ু দেব অহংকার করে বললেন যে তিনি বাতাসে যে কোনও কিছু উড়তে পারেন। তারপর যক্ষ একটি ছোট ঘাস রাখলেন এবং বায়ু দেবকে উড়িয়ে দেখাতে বললেন, কিন্তু তিনি অক্ষম হলেন। একইভাবে অন্যান্য দেবতারাও তাদের শক্তি দেখিয়েছিল, কিন্তু সবাই পরাস্ত হয়। তখন যক্ষ বললেন, তোমাদের সকল দেবতার শক্তি বাস্তবে কিন্তু তোমাদের নিজস্ব নয়। আদিশক্তি মা জগদ্ধাত্রী সর্বশক্তিমান। তিনিই সব শক্তির মূলে। তিনি এই পৃথিবীর কাঠামোর রক্ষক। তাই তাকে জগদ্ধাত্রী বলা হয়।
হুগলির চন্দননগরে পুজোর চল কীভাবে
ধন্য হয়েছি জন্মে এমন এক দেশে যেথায় দেবী দুর্গা আসেন আবারও জগদ্ধাত্রীর বেশে। দুর্গাপুজোর পর আবারও ঠিক দুর্গাপুজোর মতো একইরকম উৎসবের মেজাজ তৈরি হয় জগদ্ধাত্রী পুজো উপলক্ষে। হুগলির পুরনিগম শহর চন্দননগর সেজে ওঠে জগদ্ধাত্রী পুজোর আনন্দে। কিন্তু কীভাবে হুগলির চন্দননগরে (Chandannagar) জগদ্ধাত্রী পুজোর সূত্রপাত ঘটেছিল?
কথিত আছে, তৎকালীন ফরাসিদের দেওয়ান ছিলেন ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। তিনি ছিলেন নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের কাছে ১২ লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অক্ষম হলে নবাব রাজাকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে মুঙ্গেরে) নিয়ে যান। কারাবন্দী থাকার কারণে দুর্গাপুজো করতে পারেননি রাজা। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বিজয়া দশমীর দিনে নৌকায় ফেরার পথে তিনি সিংহবাহনী এক দেবীর স্বপ্নাদেশ পান। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয় কার্তিক শুক্লা নবমীর সময় জগদ্ধাত্রী দেবীর পুজোর আয়োজন করার জন্য।
Nov 20 2023, 07:40