*কালী কেন দীগম্বরী? দীপাবলীর আগে জানুন কালীর ইতিহাস ও গুঢ় রহস্য*
হিন্দুধর্মে প্রায় সব দেবদেবীই বস্ত্র এবং অলংকারে সজ্জিত। তাঁদের কার কী পোশাক হবে, তা নিয়েও রয়েছে নানা তত্ত্ব। একমাত্র ব্যতিক্রম মা কালী। কিন্তু কেন তাঁর গায়ে কোনও পোশাক নেই? কেন তিনি দিগম্বরী? কেন তিনি বিবসনা? শক্তির দেবী হিসেবে শ্যামা বা কালীমূর্তির আরাধনা করেন শাক্ত বাঙালিরা।হিন্দু শাস্ত্রে বলা রয়েছে, তন্ত্র মতে যে সব দেব-দেবীদের পূজো করা হয়, তাঁদের মধ্যে কালী পুজো অন্যতম। বলা হয়, যাঁরা সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করতে চান, তাঁরা তন্ত্র-মন্ত্র ক্ষমতায় বিশ্বাসী। মানুষরূপী ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চাইলে নিষ্ঠা সহকারে কালী পুজো করে থাকেন ।
সাধকের গানে বার বার বলা হয়েছে, ‘বসন পরো মা’। কিন্তু তা সে ভক্ত যতই দেবীর কাছে এমন প্রার্থনার করুন না কেন, শাস্ত্র কিন্তু অন্য কথাই বলছে। সেখানে বলা হয়েছে, মায়ের গায়ে কোনও পোশাক থাকবে না। এর কারণ কী? কোন কাহিনি রয়েছে এর পিছনে?
‘কাল’ শব্দ থেকে ‘কালী’ (Kali) শব্দের উৎপত্তি। কালের অর্থ সময়। যিনি কালদর্শী তিনিই কালী (Maa Kali) । অর্থাৎ তিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ— সবই দেখতে পান, সবই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তিনিই কালী। তাঁর ত্রিনয়ন। সেই তিন নেত্র দিয়ে তিনি তিন লোক, তিন কাল দর্শন করেন। এই তিন চোখেই তিনি সত্য, শিব এবং সুন্দরকেও দেখতে পান। আর এই ক্ষমতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মা কালীর বিবসনা হওয়ার ব্যাখ্যা।
পুরাণে মা কালীর যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে তাঁর চার হাত (Spirituality)। সেই চার হাতে রয়েছে খড়্গ, অসুরের ছিন্নমুণ্ড, বরদান ও অভয়মুদ্রা। মায়ের গলায় নরমুণ্ডমালা। তাঁরবিরাট জিভ। কালো গায়ের রং। তিনি ভগবান শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কালী হলেন শক্তির প্রতীক। আর এই কারণেই নাকি তিনি নগ্নিকা। (Diwali)
কী বলছে শাস্ত্র? কেন তিনি বস্ত্র পরিহিতা নন? শাস্ত্র মতে, দেবী এতটাই শক্তিধর, তাঁকে ধারণ করার মতো পোশাক কোথায়? পোশাক বা বসন হল এমন এক জিনিস, যা কোনও কিছুর আচ্ছাদন হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যার আচ্ছাদন হতে হবে, তাকে ঢেকে রাখার মতো ক্ষমতা থাকতে হবে পোশাকের। কিন্তু যিনি সর্বশক্তিমান, যিনি নিজে সব কিছুকে ধারণ করেছেন, যিনি নিজেই প্রকৃতি, তাকে ঢাকতে পারে কোন উপাদান? আর তাই তিনি নগ্নিকা, বিবসনা।
শাস্ত্র মতে, দেবীর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে অনন্ত রূপে। একদিকে তিনি বিনাশাকারী, অন্যদিকে সৃষ্টিকারী। তিনি অসীম। তিনি ভক্তদের রক্ষা করেন, তাঁদের মনোবাঞ্ছা পূরণ করেন, আবার তিনি দুষ্টের দমন করেন। এহেন মা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। তাই তাঁকে ধারণ করার মতো কোনও উপাদান প্রকৃতির কাছে নেই। সেই কারণেই তাঁকে বিবসনা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে।
শক্তির আরাধ্য দেবী কালীর উগ্র ও ভয়ংকর রূপ সৃষ্টির পেছনে আছে পৌরাণিক কারণ। ভারতে কালীপুজোর (Kali Puja) উত্পত্তি বিকাশ এবং প্রচলন প্রথা সম্পর্কে নানান তথ্য চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সকল তথ্য কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা তা কিন্তু বলা খুব মুশকিল। অতীত ঘাঁটলে তার উত্পত্তি সম্পর্কে নানান তথ্য আমরা পেয়ে থাকি। কালী মায়ের রূপের বর্ণনা আমরা সাধারণত কালীর যে রূপের দর্শন পাই, তিনি চতুর্ভূজা অর্থাত্ তার চারটি হাতযুক্ত মূর্তি । খড়গ, অন্যটিতে অসুর মুণ্ড অন্য হাতগুলিতে তিনি বর এবং অভয় প্রদান করেন। গলায় নরমুণ্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং রক্তবর্ণ জিভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে । এছাড়াও তিনি এলোকেশি। মা কালীকে দেখা যায় শিবের বুকের উপর পা দিয়ে জিভ বার করে দাঁড়িয়ে আছেন।
কালী পুজোর প্রচলন কবে থেকে শুরু
কালী পূজার কালী শব্দটি কাল শব্দের স্ত্রীর রূপ, যার অর্থ হল কৃষ্ণ বর্ণ বা গুরু বর্ণ। বিভিন্ন পুরাণ থেকে থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মহামায়া মা দুর্গার অন্য একটি রূপ হল কালী। প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী কালী একটি দানবীর রূপ। মহাভারতে কালীর উল্লেখ রয়েছে, সেখানে যোদ্ধা এবং পশুদের আত্মা বহন করেন যিনি, সেই তিনিই কাল রাত্রি কালী নামে পরিচিত। জানা যায়, নবদ্বীপের এক তান্ত্রিক যার নাম কৃষ্ণানন্দ তিনি বাংলায় প্রথম কালীমূর্তি বা প্রতিমা পূজার প্রচলন করেন। তার আগে মা কালীর উপাসকরা তাম্র পটে বা খোদাই করে কালীর মূর্তি এঁকে মা কালী সাধনা করতেন। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কালী পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন এবং এইভাবে মা কালীর প্রতিমা পূজার প্রচলন শুরু। উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার বিভিন্ন ধনী জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় কালীপুজোর ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়।
কালীর একাধিক রূপ
পুরাণে দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন দক্ষিণা কালী, শ্মশান কালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী ,গ্রহ কালী, চামুণ্ডা, ছিন্নমস্তা প্রভৃতি। মহাকাল সংহিতা অনুসারে মা কালীর আবার নব রূপের পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন কাল কালী, কঙ্কাল কালী, চিকা কালী এমন সব রূপের রূপের পরিচয়ও পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে ব্রহ্মময়ী , আনন্দময়ী, ভবতারিণী, আনন্দময়ী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজা বা উপাসনা করতে দেখা যায়।
কালী পূজার সময়কাল দুর্গাপূজার পরবর্তী অমাবস্যাতে দীপান্বিতা কালী পূজা করা হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তি কালীপূজা এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিণী কালীপূজা ধুমধাম করে অনুষ্ঠিত করা হয়। অনেক জায়গায় প্রতি অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ অমাবস্যায় এছাড়াও বিভিন্ন সিদ্ধ পিঠে প্রতিদিন এবং প্রতি শনি ও মঙ্গলবার মা কালী পূজার প্রচলন দেখা যায়।
পৌরাণিক কাহিনি
মা কালীর উত্পত্তির পৌরাণিক ব্যাখ্যা সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র অনুযায়ী মা কালীর আবির্ভাব সম্পর্কে যে তথ্য পাওয়া যায় তা হল পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল।দেবতারাও এই দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেবলোক তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পাওয়ার জন্য আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা করতে থাকেন । তখন দেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাঁদের কাছে আবির্ভূত হন এবং দেবীর শরীর কোষ থেকে অন্য এক দেবী সৃষ্টি হয় যা কৌশিকী নামে ভক্তদের কাছে পরিচিত দেবী কৌশিকী মা মহামায়া দেহ থেকে নিঃসৃত হলে কালো বর্ণ ধারণ করে যা দেবী কালীর আদিরূপ বলে ধরা হয়। কালী পূজার বিভিন্ন পদ্ধতি তান্ত্রিক পদ্ধতিতে মধ্যরাত্রে অর্থাত্ অমাবস্যার রাত্রে মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে কালী পূজা করা হয়। আগেকার দিনে, দেবীকে সন্তুষ্ট করতে পশু রক্ত বা পশু বলি করে উত্সর্গ করা হয়। এছাড়াও প্রসাদ হিসেবে লুচি এবং নানা ফল ভোগ দেওয়া হয়ে থাকে। গৃহস্থ বাড়িতে সাধারণত অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ মতে মা কালীর পুজা দেখা যায় ।এক্ষেত্রে অনেক সময় জমিদার বাড়িতে ছাগ বা মহিষ ছাগল বা মহিষ বলি দেওয়া হত এবং বর্তমানেও অনেক জায়গায় পশু বলির মাধ্যমে পূজার প্রচলন দেখা যায় । পুরাকালে বা প্রাচীন সময়ে বিভিন্ন ডাকাতের দল নরবলির মাধ্যমে কালী পূজা করত করত বলে শোনা যায়।
Nov 11 2023, 09:37