*বীর যতীন দাস জন্মদিন স্মরণে*
খেঁদুর যখন ন'বছর বয়স তখন মা হারালেন। তাই মা-হারা কনিষ্ঠ সন্তানটির প্রতি সমস্ত মমত্ব গিয়ে পড়ল পিতা বঙ্কিমবিহারী দাসের। সকল দুরন্তপনা আর স্নেহের আবদার অকৃপণ ভাবে মিটিয়ে দিতেন তিনি এবং তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও।
কিন্তু মাতৃস্নেহের ক্ষিধে কে মেটাবে তাঁকে?
তাই বোধহয় একটু বড়ো হতেই তাঁর সমস্ত প্রেম গিয়ে পড়েছিল পরাধীন দেশ মাতৃকার চরণে।
মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেই যোগ দিলেন গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে। ধরা পড়ে বন্দী হলেন ময়মনসিংহের সেন্ট্রাল জেলে। বাড়ির লোকেরা তখন কেউ জানেনা। সেদিন জেলে বন্দীদের প্রতি অমানুষিক দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে ২৩ দিন অনশন করে জেল সুপারের কাছ থেকে লিখিত এবং নিঃশর্ত ক্ষমা আদায় করে যখন বাড়ি ফিরলেন তখন পরিবারের সবাই তো অবাক হলেনই এবং সমগ্র দেশে তাঁর নামে ধ্বনি উঠল
"বীর যতীন দাস জিন্দাবাদ।"
তারপর…
সালটা ১৯২৮ ।
আন্দোলনে আন্দোলনে জেরবার ইংরেজ সরকার।
পাশবিক দমননীতিতে ও স্তব্ধ করতে পারলনা বিপ্লবীদের।
ধূর্ত ইংরেজ নিল চালাকির আশ্রয়। গঠন করল সাইমন কমিশন।
কমিশন ঠিক করবে ভারতীয়দের দুঃখ দুর্দশা কিভাবে লাঘব করা যায় ! ! !
বাহ্! এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম ! ! অথচ একজনও ভারতীয়কে রাখা হলনা ঐ কমিটিতে।
ভাবুন,
ওরা করবে ভারতীয়দের মঙ্গল সাধন ! !
বিপ্লবীরা মানলো না এই কমিশন।
অতএব যুদ্ধ জারি।
৩০ অক্টোবর।
পাঞ্জাবে লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হল মৌন মিছিল। সেই মিছিলের উপর পুলিশের নৃশংস লাঠিচার্জ। ভগৎ সিংয়ের সামনে লুটিয়ে পড়লেন লাজপত। ১৭ দিনের মাথায় মারা গেলেন তিনি।
স্থির হল এর প্রতিশোধ চাই!
পুলিশ প্রধান স্কট সাহেবের মৃত্যু চাই।
ভগৎই কাঁধে তুলে নিল এই দায়িত্ব।
বিফল হল স্বপ্ন। স্কটকে মারতে গিয়ে
ভগতের গুলিতে মারা পড়ল আন্ডারসন।
চুল দাঁড়ি কেটে ছদ্মবেশে পালিয়ে এলেন কলকাতায়, যতীন্দ্রনাথ দাসের কাছে ।
যতীন ও তখন ইংরেজদের কাছে দাগী আসামি।
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা সহ হাজারটা মামলা ঝুলছে তাঁর মাথায়। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হচ্ছে তাঁকে। ধরা পড়লেই ফাঁসি!
তাতে কিসের ভয়! দেশের চেয়ে প্রাণ বড়ো?!!!
সুতরাং হানো আঘাত!
ঠিক হল, লেজিসলেটিভ আ্যসেমব্লিতে বোমা ফেলতে হবে।
এই কাজে যতীন সবরকম সাহায্য করতে লাগলো।
বাংলার বিপ্লবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে এবং অস্ত্র শস্ত্র যোগাড় করে ভগৎ সিং কে দিলেন।
১৯২৯ এর ৮ ই এপ্রিল।
নিচ্ছিদ্র পুলিশি প্রহরা ভেদ করে নির্ভীক ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত আ্যসেমব্লিতে বোমা নিক্ষেপ করলেন।
বাইরে তাদেরকে উদ্ধার করে আনতে অপেক্ষা করছিল যতীন দাস সহ অন্য বিপ্লবীরা।
ধরা দিলেন ভগৎ আর বটুক দত্ত।
দুমাস পর ধরা পড়লেন যতীন। লাহোর জেলে চালান করা হল তাঁকে।
জেলের ভেতর একি জঘন্য পাশবিক অত্যাচার! জেল কর্তৃপক্ষকে প্রতিবাদ জানিয়ে ও কোন লাভ হলোনা।
যতীন দাস অনশন শুরু করলেন।
টানা ৬৩ দিন! এই ৬৩ দিনের মধ্যে অনশন ভাঙানোর জন্য
অভূক্ত এই মানুষটির প্রতি সভ্যতা দেখানো তো দূরের কথা প্রতিদিন নির্যাতন করেছে, তাঁর বুকের উপর পা তুলে খাওয়ানোর চেষ্টা হয়েছে।
অবশেষে ১৩ সেপ্টেম্বর, মাত্র ২৪ বছর বয়সে মৃত্যুকে বরণ করেন বীর বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাস।
প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সমগ্র ভারতবর্ষ।
সুভাষ চন্দ্র নিজের উদ্যোগে যতীন দাসের লাশ লাহোর থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় নিয়ে এলেন।
দু লক্ষের ও অধিক মানুষ শেষ যাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল সেদিন।
প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ সেই রাতেই লিখলেন
'সর্ব খর্ব তারে দহে তব ক্রোধ দাহ' গানটি , যেটি পরে 'তপতী' নাটকে অন্তর্ভুক্ত হয়।
আজ তাঁর ১২০তম জন্মদিনে এই মৃত্যুঞ্জয়ী অমর বীরকে চোখের জলে শ্রদ্ধা পাল।
Oct 27 2023, 07:54