*কবি প্রণাম*
কবি প্রণাম
কী যাদু তাঁর গানে
ড. অরবিন্দ শীট
রবীন্দ্রসঙ্গীত হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত ও সুরারোপিত গান। বাংলা সংগীতের জগতে এই গানগুলি একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী। রবীন্দ্রনাথের জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ও আমার সোনার বাংলা গানদুটি যথাক্রমে ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। এছাড়া ভারতের জাতীয় স্তোত্র বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত বন্দে মাতরম্ গানটিতে রবীন্দ্রনাথই সুরারোপ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত মোট গানের সংখ্যা ২২৩২। তার গানের কথায় উপনিষদ্, সংস্কৃত সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য ও বাউল দর্শনের প্রভাব সুস্পষ্ট। অন্যদিকে তার গানের সুরে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের (হিন্দুস্তানি ও কর্ণাটকি উভয় প্রকার) ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, তরানা, ভজন ইত্যাদি ধারার সুর এবং সেই সঙ্গে বাংলার লোকসঙ্গীত, কীর্তন, রামপ্রসাদী, পাশ্চাত্য ধ্রুপদি সঙ্গীত ও পাশ্চাত্য লোকগীতির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথের সকল গান গীতবিতান নামক সংকলন গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। উক্ত গ্রন্থের ১ম ও ২য় খণ্ডে রবীন্দ্রনাথ নিজেই তার গানগুলিকে ‘পূজা’, ‘স্বদেশ’, ‘প্রেম’, ‘প্রকৃতি’, ‘বিচিত্র’ও ‘আনুষ্ঠানিক’ – এই ছয়টি পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর গীতবিতান গ্রন্থের প্রথম দুই খণ্ডে অসংকলিত গানগুলি নিয়ে ১৯৫০ সালে উক্ত গ্রন্থের ৩য় খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই খণ্ডে প্রকাশিত গানগুলি ‘গীতিনাট্য’, ‘নৃত্যনাট্য’, ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’, ‘নাট্যগীতি’, ‘জাতীয় সংগীত’, ‘পূজা ও প্রার্থনা’, ‘আনুষ্ঠানিক সংগীত, ‘প্রেম ও প্রকৃতি’ ইত্যাদি পর্যায়ে বিন্যস্ত। ৬৪ খণ্ডে প্রকাশিত স্বরবিতান গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সঙ্গীতচর্চার ব্যাপক প্রচলন ছিল। রবীন্দ্রনাথের বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য দাদারা নিয়মিত সংগীতচর্চা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে করতেন। কিশোর বয়সে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতশিক্ষায় সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার নতুনদাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। এগারো বছর বয়সে লেখা ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ গানটি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক রচিত প্রথম গান। এরপর প্রায় ৭০ বছর ধরে তিনি নিয়মিত গান রচনা করে গিয়েছিলেন। স্বরচিত গীতিকবিতা ছাড়াও কয়েকটি বৈদিক স্তোত্র ও বৌদ্ধ মন্ত্র এবং বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়াল, সুকুমার রায় ও হেমলতা দেবী কর্তৃক রচিত কয়েকটি গানে সুরারোপ করেছিলেন। তার লেখা শেষ গানটি হল ‘হে নূতন দেখা দিক আর বার’। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় তার শেষ জন্মদিনে এটি পরিবেশিত হয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও সুগায়ক ছিলেন। বিভিন্ন সভাসমিতিতে তিনি স্বরচিত গান পরিবেশন করতেন। কয়েকটি গান তিনি গ্রামোফোন ডিস্কেও প্রকাশ করেছিলেন। সঙ্গীত প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রবন্ধও তিনি রচনা করেন। এছাড়া স্বরচিত নাটকেও তিনি নিজের গান ব্যবহার করতেন। সঙ্গীতকে তিনি বিদ্যালয়-শিক্ষার পরিপূরক এক বিদ্যা মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তার রচিত গানগুলি বাঙালি সমাজে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
May 09 2023, 15:25