*বিশেষ নিবন্ধ* নববর্ষ, নতুন ধানের মত
ড. অরবিন্দ শীট
রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান ‘এসো হে বৈশাখ এসো হে, এসো হে’-এর মাধ্যমে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়।বাংলার ছয়টি ঋতুর মধ্যে দিয়ে দুটি করে বারোটি মাস আবর্তিত হয়। নতুন বছরের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ…….. নববর্ষ বলে বরণ করে নেওয়া হয় এ দিনটিকে। নতুন সব জিনিসেরই আলাদা একটা বৈচিত্র্য আছে। নববর্ষ আসে তারুণ্যের প্রদীপ্ত প্রদীপ হাতে নিয়ে। আমাদের জীবনে ঐতিহ্যপূর্ণ এই দিনটি বছরের অন্য সব দিন থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে ধরা দেয়।
খাজনা আদায়ে সুবিধার জন্য মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সেন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম প্রবর্তন করেন।
আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে বাধ্য থাকত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন।
ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়। জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় বাংলা নববর্ষ পালিত হয়।
বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন বৈশাখ। কৃষিভিত্তিক আমাদের এই দেশের সব আনন্দ উৎসবের নিবিড় যোগ রয়েছে ফসলের সঙ্গে। আমাদের নববর্ষের সাথেও সম্পৃক্ত রয়েছে ফসল বোনার আনুষ্ঠানিকতা। চৈত্র মাসে ফসল বুনলে ফলনের দিক থেকে ভালো হয় না এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে বাংলার কৃষক সমাজ বৈশাখ মাসে ফসল বোনার সূচনা করে। তাছাড়া পহেলা বৈশাখে বাঙালিরা অতীতের সুখ-দুঃখ ভুলে নতুনের আহ্বানে সাড়া দেয়। নতুনকে গ্রহণ করার জন্য উদ্দীপ্ত হয়। তাই পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ বলা হয়।
বর্তমানে নগরজীবনে নগর-সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপিত হয়। পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের বা লেকের ধারে ভোরবেলা নগরবাসীরা সমবেত হয়। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করে। এদিন সাধারণত সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে।
বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে উপজাতীয়দের ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ আনন্দমুখর পরিবেশে পালিত হয়। এটি পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসবকে চাকমারা ‘বিজু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং ত্রিপুরারা ‘বৈসুক’ বলে আখ্যা দিলেও গোটা পার্বত্য এলাকায় তা ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত।
আমাদের জাতীয় চেতনা অর্থাৎ বাঙালি সত্তার সঙ্গে পহেলা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতির অস্থিমজ্জার সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বাংলা নববর্ষের মাহাত্ম। রূপকথার জিয়ন কাঠির মর্মস্পর্শে দূরীভূত হয় পুরানো দিনের সকল জরাজীর্ণতা। নতুনের ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে ওঠে বাঙালির ক্লান্ত-শ্রান্ত জীবন। প্রতিবছর এ দিনটি আমাদের সামনে হাজির হয় নতুনের বার্তা- আশার আলো নিয়ে। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের কাছেই দিনটি হয়ে উঠে উৎসবমুখর।
পহেলা বৈশাখ-ই একমাত্র উৎসব যা কোনো ধর্ম বা গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি গোটা জাতির তথা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অখণ্ড বাঙালি জাতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গে দেশের সকল মানুষ একই সময় অভিন্ন আনন্দ-অনুভূতিতে উদ্বেল হয়ে পড়ে। তারা নিজেদের মনে করে এক অখণ্ড সত্তা রূপে। ফলে জাতিগত সংহতি ও ঐক্য সুদৃঢ় হয়ে মানুষে মানুষে, ধর্মে ধর্মে, বর্ণে বর্ণে দূরত্ব কমে আসে। নববর্ষ পরিণত হয় একটি সার্বজনীন অনুষ্ঠানে।
আজ নববর্ষের এই শুভক্ষণে, আসুন, কবিকণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা বলি,
“যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো সব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার”।
Apr 16 2023, 07:21